Ujaanjatra

"Ujaanjatra" by Ujjal Sinha

মফস্বলের কোনও এক বালক। বাড়িতে, বাইরে সবাই বাবু বলেই ডাকে তাকে। অন্তর্মুখী, একটু চাপা স্বভাবের বাবু পড়াশোনায় ভাল। তার আঁকার হাতও খারাপ নয়, কিন্তু বাকি সব কাজে সে একটু অপটু। সে সাঁতার জানে না, নিজে হাতে খেতে পারে না ভাল করে, কিন্তু সে স্থিতধী, তার দৃষ্টি আর স্মৃতি প্রখর। যা কিছু একবার দেখে তা মনে ধরে রাখে সারা জীবনের জন্য। তার জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সংখ্যা। সিঁড়ির ধাপ থেকে দরজা, জানালা, সে যেন অচেতনেই গুনে ফেলে তার দেখা সবকিছুর সংখ্যা।

বাবু নিজের ভিতরে একটা মায়াবী, জাদুময় দুনিয়া লুকিয়ে রেখেছে সবার থেকে। সেই দুনিয়ায় একটা আশ্চর্য দিঘি আছে যা তার ইচ্ছা মতো নিজেকে নিত্য গড়ে, ভাঙে। বাবু জানে সেই দিঘির পাড়ে অনেক গাছই আসলে গাছ নয়, মানুষ! যে মানুষ আর মানুষ হয়ে বাঁচতে চায় না, সেখানে গিয়ে সে নিজের ইচ্ছা মতো পছন্দের গাছ হয়ে গজিয়ে উঠতে পারে! এই দিঘির প্রতিটি গাছ, জলের মাছ, ফুলের মধু খেতে আসা প্রজাপতি; এদের সবার সঙ্গে তার গভীর আত্মীয়তা। ছোটবেলায় না বুঝলেও একটু বড় হয়ে সে বোঝে এ দিঘি আসলে এক ধরণের মনের অসুখ; একে ডাক্তারির ভাষায় ‘প্যারাকজম' বলে। কিন্তু জীবনের নানা বাঁক, ওঠাপড়া সে মানিয়ে নেয় ওই দিঘিটাকে আশ্রয় করে।

বাবুর এই মায়াবী ভিতরের জগতে বাস করে আরও একজন, যার নাম মিলন। সে মোটেই বাবুর মতো গুটিয়ে থাকা তথাকথিত ভাল ছেলে নয়। সে ডানপিটে। সাহসী, কখনও কখনও মারকুটেও বটে। সে নানা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে, অচেনা পরিস্থিতির মোকাবিলা করে সহজে! সে আর বাবু এক্কেবারে আলাদা, অন্য রকমের মানুষ। সে সারা সময় বাবুর সঙ্গে থাকলেও বাবু ছাড়া তাকে আর কেউ দেখতে পায় না। সে আর বাবু সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও একে ওপরের সঙ্গে জুড়ে থাকে সেই প্রথম দিন থেকে। মিলন আসলে বাবুর প্রতিরূপ— অল্টার ইগো। দ্বৈত সত্তা।

বাবুর বহির্জগতে আছে এক প্রকাণ্ড পরিবার। অরণ্যের মতো প্রাচীন এবং গহন সেই পরিবারে সবার অভিভাবক বীণাপাণি, বাবুর ‘ঠাম্মা'। বীণাপাণি এই নাতিটির প্রতি একটু বেশি উদার, তাকে একটু যেন বেশিই ভালবাসেন। এই নাতিকে মনের কথা বলতে তার দ্বিধা নেই। আসলে সে ভাবে দেখলে এই পরিবারে সবাই বাবুকে একটু বেশিই ভালবাসে। একটু বেশি কাছে টেনে রাখে তাকে।

বাবুর চেতনে সদা জেগে থাকে সেই কোন ছোটবেলা থেকে শোনা স্বগতোক্তির মতো করে বীণাপাণির বলা যমের উদ্দেশ্যে নানা বাক্য। আর বাচ্চা বয়সে বাড়ির পাশের পুকুরে ডুবে যাওয়ার স্মৃতি। জল তাকে টানে। গভীর ভাবে। সেই টান তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে আরব সাগরে। আবার একবার ডুবে যায় সে। এই বারবার ডুবে যাওয়া আর ভেসে ওঠা হয়ে ওঠে তাঁর জীবনে চলার পথের গল্প। মৃত্যুকে সে বারবার প্রায় ছুঁয়ে দেখে আসে কাছ থেকে। তাই যখন তার প্রিয় আত্মীয় আত্মহত্যা করেন, বাবু তাঁর স্মৃতি স্মরণে রাখে দু-চারটে তুচ্ছ জিনিস আর ঘটনাকে অবলম্বন করে। জীবন তাকে শিখিয়েছে কঠিন সময়ে টিকে থাকার জাদুমন্ত্র। তাঁর জীবনে আরও নানা চরিত্ররা আসে একে একে। তৈরি করে এক অদ্ভুত বাস্তুতন্ত্র। ছোটবেলা মফস্বলের নিজের বাড়ির পৃথিবীতে সে যেমন দেখে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ, আবার কলকাতায় আসার পরে অসমবয়সী বন্ধু বিশুদা দেখিয়ে দেন নতুন ভাবে বাঁচার ছবি। লাতেহারে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করতে চলে যাওয়া থেকে শুরু করে কাজের সূত্রে আমেরিকায় পৌঁছে যাওয়া, বাবু গা ভাসিয়ে দেয় সময়ের স্রোতে। তার চির সঙ্গী নিজের অল্টার ইগো মিলন কখনও তাকে ঠেলে দেয় মারপিটের মধ্যে, কিংবা তারই হাত ধরে বাবু কৈশোরে পৌঁছে যায় বস্তির গুন্ডাদের মধ্যে, সেখানেই সে খুঁজে পায় নারী শরীর ও যৌনতার প্রথম সাক্ষাৎ। আবার এই মিলনই আবার তাকে পড়িয়ে দেয় জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।

তার জীবনে প্রেম আসে অতর্কিতে। বাল্যের সহচরী স্নিগ্ধাকে নিয়ে সে দ্বন্দ্বে থাকে। স্নিগ্ধা কী তার জীবনে? মাঝদরিয়ার নৌকো নাকি বিকল মহাকাশযানের এসকেপ হ্যাচ? স্নিগ্ধার থেকে দূরে গিয়ে বার বার সে ফিরে আসে এক অমোঘ আকর্ষণে। পারবে কি থিতু হতে কোনও দিন তার এই প্রেমের সঙ্গে— অবিরল নিজের সঙ্গেই নিজে তর্ক জোড়ে বাবু। তার ভিতরের নানা সত্তা তাকে কখনও বিভ্রান্ত করে, কখনও বা মনে করিয়ে দেয় থেমে গেলে সব বৃথা। সে জানে তাকে এগোতে হবে এই সব কিছুকে মানিয়ে নিয়ে। মেনে নিয়ে। তার মনের মধ্যে সব সময় তীব্র হয়ে জেগে থাকে তার ঠাম্মার বলা সেই অমোঘ কথা, জীবনকে কোনও একটি জায়গা থেকে দেখতে দেখতে যদি সাদামাটা মনে হয়, তাহলে জায়গা বদল করে নিতে হয়। বাবু তার জীবনে এই কথাটি জড়িয়ে ধরে প্রাণপণে, আপ্তবাক্যের মতো মেনে চলে সব সময়। আর তাই মনোজগত থেকে বাস্তবের পৃথিবী, বাবু সরে সরে যায়, ক্রমশ জায়গা বদল করে নেয় একের পর এক। ম্যাজিকের খোঁজে, জীবনকে বর্ণময় করে তোলার অমোঘ তাগিদে। এই জায়গা বদল খুঁজে পাওয়া যায় উপন্যাসের প্লট বিন্যাসেও। অনেক সময় স্মৃতি এবং বর্তমান মিলেমিশে গিয়ে তৈরি করে এক অদ্ভুত সময়-হারানো যাত্রাপথ। বাবু কখনও তীব্র বেগে ছুটে চলে বর্তমানের হাইওয়ে ধরে, আবার কখনও দু-দণ্ড বিশ্রাম নেয় অতীত রোমন্থনে, চুপিচুপি পৌঁছে যায় তার সেই একান্ত নিজের দিঘির কাছে। বাবু যেন তার এই জীবনের যাত্রাপথে একের পর এক পেরিয়ে যায় অনুভব, স্মৃতি, আশ্চর্য সব ঘটনার চড়াই উৎরাই। এ যাত্রা বন্ধুর। এ যাত্রা আসলে উজানযাত্রা। যে যাত্রা ঠিকানা খোঁজে না, বরং খুঁজে বেড়ায় জীবনের শাশ্বত অর্থ।

Copyright@genesis 2024